গুলশানে নৃশংস হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে দেশে জঙ্গিবাদ এক ভয়ংকর স্তরে পৌঁছেছে। ব্যক্তি, আক্রমণ, লক্ষ্যবস্তু ও অস্ত্রের ধরন বিশ্লেষণ করে একে দেশে বিপজ্জনক জঙ্গিবাদের তৃতীয় পর্যায় বলা যায়। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের গোড়াপত্তন হয়েছিল আফগান ফেরত মুজাহিদদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে, গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরুতে।
দেশে ধর্মভিত্তিক উগ্র গোষ্ঠীর কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে জঙ্গিদের তৎপরতার সময়টাকে মোটা দাগে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে আশির দশকের মধ্যভাগে জন্ম নেওয়া মুসলিম মিল্লাত বাহিনী ও শেষ দিকে জন্ম নেওয়া হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশকে (হুজি-বি) এ দেশে প্রথম প্রজন্মের জঙ্গি সংগঠন বলা যায়। এর এক দশক পর জন্ম নেয় জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), যার লক্ষ্য ছিল দেশে শরিয়াহ আইন প্রতিষ্ঠা করা। জেএমবির জন্মের ঠিক এক দশক পর উত্থান ঘটে বর্তমানে সক্রিয় দুই জঙ্গিগোষ্ঠীর। এর একটি ব্লগার হত্যার ঘটনায় জড়িত আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসার আল ইসলাম। এরা আল–কায়েদার অনুসারী। অপর গোষ্ঠীকে পুলিশ বলছে ‘নব্য জেএমবি’। তবে তারা নিজেদের ইসলামিক স্টেট বা আইএস বলে দাবি করে। এই দুই গোষ্ঠীতেই মাদ্রাসাপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানেরাও যুক্ত হয়েছেন, যার একটি রূপ দেখা গেছে গুলশানে।
মুসলিম মিল্লাত বাহিনীর প্রধান চাকরিচ্যুত মেজর মতিউর রহমান মধ্যপ্রাচ্য ঘুরে এসে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার শিমুলিয়ায় নিজ গ্রামে আস্তানা গড়ে তোলেন। পাঁচ একরের ওই আস্তানায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু করেন। কিন্তু এলাকায় তিনি পীর মতিউর নামে পরিচিতি পান।
পাকুন্দিয়ার ওই আস্তানায় সদস্যদের থাকার জন্য ১৩১টি ঘর ও বেশ কিছু তাঁবু এবং ৬১টি পরিখা (বাংকার) তৈরি করা হয়েছিল। ছিল নিজস্ব জেনারেটরে বিদ্যুতের ব্যবস্থা। একটা মাদ্রাসাও করা হয়েছিল সেখানে। নাম ‘শিমুলিয়া ফরজে আইন মাদ্রাসা’। তার ফরজে কেফায়া বিভাগে যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা দেওয়া হতো। ওই প্রতিষ্ঠানের তিন শতাধিক ছাত্রের সবাই ছিল কুমিল্লা, যশোর, ঝিনাইদহ, চাঁদপুর, মাগুরা, কুষ্টিয়া ও নারায়ণগঞ্জ এলাকার।
১৯৮৯ সালের ১২ ডিসেম্বরে পুলিশ পীর মেজর (অব.) মতিউর রহমানের আস্তানায় অভিযান চালাতে গেলে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ হয়। আড়াই দিন ধরে চলে ওই বন্দুকযুদ্ধ। এতে পুলিশের দুই সদস্যসহ ২১ জন নিহত হন। আহত হন ২০ জন। পুলিশের পাঁচ শতাধিক সদস্য ওই অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে মর্টারের গোলাবর্ষণও করতে হয়েছিল। আহত অবস্থায় পালাতে গিয়ে পীর মতিউর ও তাঁর ৪৮ সঙ্গী গ্রেপ্তার হন। তাঁর আস্তানা থেকে রাইফেল, রিভলবার, বন্দুক, তির-ধনুক, বল্লম, লাঠি, তলোয়ারসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গুলি, খাকি পোশাক ও সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার হয় ২৭টি পাসপোর্ট, যেগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের ভিসা ছিল। দেশে ধর্মীয় জঙ্গিগোষ্ঠীর সশস্ত্র তৎপরতার ওটাই ছিল প্রথম বহিঃপ্রকাশ।
পীর মতিউর রহমানের গ্রেপ্তারের পর মুসলিম মিল্লাত বাহিনীর আর কোনো তৎপরতার খবর পাওয়া যায়নি। যদিও মতিউর রহমান পরবর্তী সময়ে জামিনে বেরিয়ে যান। এরপর তাঁর গতিবিধির ওপর কোনো নজরদারি করা হয়নি। একটি গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চপর্যায়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক বছর আগে সর্বশেষ জানা গিয়েছিল, মতিউর রহমান তাঁর দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্ত্রীকে নিয়ে রাজধানীর খিলগাঁওয়ে বসবাস করছেন। তবে গত দুই বছর চেষ্টা করেও তাঁর সম্পর্কে আর কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধের শেষের দিকে আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তের খোস্ত রণাঙ্গনে হুজির জন্ম হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, যেখানে বা যে দেশে জিহাদ বা ধর্মযুদ্ধ হবে, সেখানে মুজাহিদ পাঠানো। বাংলাদেশে সংগঠনটির শাখা খোলা হয়েছিল মিয়ানমারের আরাকানে স্বাধীনতাকামী রোহিঙ্গা মুসলমানদের হয়ে লড়াই করার জন্য।
১৯৮৯ সালে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি-বি) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যশোরের মনিরামপুরের মাওলানা আবদুর রহমান ফারুকী। কিন্তু ওই বছরই আফগানিস্তানের খোস্তে মাইন অপসারণের সময় মাওলানা ফারুকী নিহত হন। পরে ১৯৯২ সালে ৩০ এপ্রিল ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ করে হুজি-বি। আফগানফেরত মুজাহিদদের বেশির ভাগই এর সঙ্গে যুক্ত হন। তাঁরা ছিলেন এ দেশে ভারতের দেওবন্দ ধারার মাদ্রাসায় শিক্ষিত এবং হানাফি মাজহাবের। তবে সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অনেকে পাকিস্তানের বিভিন্ন মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছিলেন। আফগান যুদ্ধের সময় তাঁরা গেরিলাযুদ্ধ ও ভারী অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন। এই নেতাদের গড়া সংগঠন হুজি-বিকে এ দেশে জঙ্গি তৎপরতার গোড়াপত্তনকারী বলে মনে করা হয়।
সংগঠনের শুরুর দিকে এসব আফগান মুজাহিদ ছিলেন এ দেশে দেওবন্দ ধারার কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের কাছে বিরাট শ্রদ্ধার পাত্র। আর সেই ভাবমূর্তিকে কাজে লাগিয়ে তাঁরা আরাকানের ‘মজলুম মুসলমানদের’ পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে দেশের বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে সদস্য সংগ্রহ শুরু করেন। তাঁরা বাছাই করা সদস্যদের জন্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন। এসব প্রশিক্ষণকেন্দ্র নিয়ে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে নানা খবর বের হয়েছিল।
১৯৯২ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ছিল হুজি-বির উত্থান ও বিস্তারপর্ব। হুজি-বির সমসাময়িক সময়ে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকায় সংগঠিত ও সক্রিয় হয় রোহিঙ্গাদের দুই সশস্ত্র সংগঠন আরএসও (রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন) ও এআরএনও (আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন)। হুজি-বি ও রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা ছিল একে অন্যের সহযোগী। তখন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহযোগিতার নামে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক বিভিন্ন এনজিও থেকে বিপুল অর্থসাহায্যও এসেছিল বলে পরবর্তী সময়ে গণমাধ্যমে খবর বের হয়। ২০০৩, ২০০৪ ও ২০০৫ সালে নাইক্ষ্যংছড়ির জঙ্গল থেকে বিডিআর-র্যাব বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র উদ্ধার করেছিল, যা রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠনগুলোর বলে ধারণা করা হয়।
উদীচীর হামলার সাত মাসের মাথায় ৮ অক্টোবর খুলনায় আহমদিয়া মসজিদে বোমা হামলায় আটজন নিহত হন। তারপর ২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভাস্থলের কাছে ও হেলিপ্যাডে বোমা পেতে রাখার ঘটনা ধরা পড়ার পর প্রথম হরকাতুল জিহাদ ও মুফতি হান্নানের নাম জানাজানি হয়। তবে মুফতি হান্নানকে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এরপর ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে রমনার বটমূলে, ৩ জুন গোপালগঞ্জের বানিয়ারচরে গির্জায়, ১৬ জুন নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে বোমা হামলা হয়।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জে সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে হত্যা করা পর্যন্ত হুজি-বি ৬ বছরে দেশে ১৩টি বোমা ও গ্রেনেড হামলা চালায়। এতে মোট ১০৯ জন নিহত হন। আহত হন ৭০০ জনের বেশি মানুষ। অনেকে চিরতরে পঙ্গু হয়ে যান।
এর মধ্যে হুজি-বির জঙ্গিরা সবচেয়ে বড় ও ভয়াবহ হামলা চালায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার জনসভায়। ওই গ্রেনেড হামলায় ২২ জন নিহত হন। আহত হন শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কয়েক শ নেতা-কর্মী। এ ঘটনার পর আর্জেস গ্রেনেড আলোচনায় আসে। একই ধরনের গ্রেনেড ব্যবহার করে ২০০৪ সালের ২১ মে সিলেটে হজরত শাহজালালের (রহ.) মাজারে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর হামলা চালানো হয়েছিল। পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে যে এসব গ্রেনেডের চালান এসেছিল পাকিস্তান থেকে।
পরবর্তী সময়ে মুফতি হান্নানসহ একাধিক জঙ্গিনেতা আদালতে জবানবন্দিতে বলেছেন, এসব গ্রেনেড এসেছিল পাকিস্তান থেকে। আনোয়ার চৌধুরী ছাড়া বাকি হামলার বেশির ভাগই ছিল শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের লক্ষ্য করে। কিন্তু আগের আওয়ামী লীগ সরকারের মতো পরে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারও এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি। উপরন্তু ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় জজ মিয়া নাটক সাজিয়ে তদন্তকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করে বিএনপি সরকার। যদিও এসব হামলার প্রধান পরিকল্পনাকারী মুফতি হান্নানকে বিএনপি সরকারের আমলেই ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর ঢাকার বাড্ডার আস্তানা থেকে র্যাব গ্রেপ্তার করেছিল। তাঁকে টানা ১২০ দিন রিমান্ডে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আর তখনই মুফতি হান্নান ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার কথা স্বীকার করে এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নাম বলেছিলেন। কিন্তু র্যাব বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তা গোপন করে। মামলাটি ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টার শুরু থেকেই এ বিষয়সহ হুজি-বির তৎপরতার বিষয়ে প্রথম আলো টানা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসতে থাকে পুরো তথ্য। পরে ২০০৭ সালে এক-এগারোর পটপরিবর্তনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে ২১ আগস্ট মামলার নতুন করে তদন্তের উদ্যোগ নেয়। ২০০৮ সালে মুফতি হান্নান, বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তাঁর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিনসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। পরে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার এসে অধিকতর তদন্ত করিয়ে বিএনপি নেতা তারেক রহমান, জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, বিএনপি সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাসহ আরও ৩০ জনকে আসামি করে। মামলাটির বিচার চলছে এখন।
এর মধ্যে মুফতি হান্নান হুজি নামেই তৎপরতা চালালেও মুফতি রউফের সংগঠনের সর্বশেষ নাম ছিল তাআমির উদ-দীন বাংলাদেশ। অবশ্য হুজির মূলধারার দাবিদার অংশের নেতারা বিভিন্ন সময়ে দাবি করেছিলেন, মুফতি হান্নান হুজি নামে তৎপরতা চালালেও তাঁর সঙ্গে পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল মুজাহিদীনের যোগাযোগ ছিল। আফগানিস্তানে যুদ্ধ চলাকালে হান্নান পাকিস্তানে হরকাতুল মুজাহিদীনের সঙ্গে যুক্ত হন বলে তাঁদের দাবি।
হুজি-বির বিষয়ে ওয়াকিবহাল একাধিক সূত্রের দাবি, মুফতি হান্নান ও তাঁর সংগঠন একটা পর্যায়ে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ও পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তাইয়েবার ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। আর এ ক্ষেত্রে বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন ছিলেন একজন সমন্বয়ক। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে প্রভাবশালী একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের কেউ কেউ হুজির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। পরবর্তী সময়ে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্তে এমন তথ্য-প্রমাণ মেলায় কয়েকজন কর্মকর্তাকে আসামি করা হয় এবং কয়েকজন রাজসাক্ষী হন।
হুজির নেতারা তিন ভাগে ভাগ হওয়ার দাবি করলেও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার তদন্তে যুক্ত সিআইডির একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার মতে, ভেতরে ভেতরে তাঁরা সবাই ছিলেন এক।
বিএনপি সরকারের সর্বশেষ মেয়াদে (২০০১-০৬) জঙ্গিগোষ্ঠীর বিষয়ে নির্লিপ্ত থাকা, ক্ষেত্রবিশেষে সহযোগিতার (২০০৪ সালে রাজশাহীর তিনটি উপজেলায় বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে জেএমবির তৎপরতা) অভিযোগ প্রকট ছিল। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জেএমবি দেশব্যাপী বোমা হামলা চালানোর পর বিএনপি সরকার জঙ্গিবিরোধী অভিযানে সক্রিয় হয়। এরপর জেএমবির শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাইকে গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনে। কিন্তু মুফতি হান্নান ছাড়া হুজির আর কোনো উল্লেখযোগ্য নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি তখন। হুজির নেতাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখার বিষয়েও প্রথম আলোতে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় ২০০৫ সালে। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে হুজির মূলধারার দাবিদার অংশ ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এক বছরের মধ্যে হুজির কথিত মূলধারাসহ তিন অংশেরই প্রায় সব শীর্ষস্থানীয় নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ জঙ্গিরা গ্রেপ্তার হন। মূলত এরপর এ দেশে হুজি বা প্রথম প্রজন্মের জঙ্গি দলটির যুগের সমাপ্তি ঘটে। যদিও মাঝে হুজির কারাবন্দী নেতা মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে আবু জাফরের কিছু অনুসারী নতুন নামে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাঁরা সবাই গত বছরের অক্টোবর ও নভেম্বরে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যান।
২০০৫ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক ডেইলি টাইমস-এর সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল, ইসলামি জঙ্গি তৎপরতার ব্যাধিটির জন্ম পাকিস্তানের করাচি ও খোস্তে। এখন তা পাচার হয়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলেই সর্বত্র পাকিস্তানি প্রভাব পরিলক্ষিত হবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটিজ স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো শাফকাত মুনীর প্রথম আলোকে বলেন, আফগান ফেরত মুজাহিদরা কেবল বাংলাদেশে নয়, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, চেচনিয়াসহ নানা দেশে জঙ্গিগোষ্ঠী তৈরি করে সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করেছিল। এরা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য কতটা হুমকি হতে পারে তা ১৯৯৯ সাল থেকে হুজি-বির নাশকতার পর থেকে বোঝা যায়। তিনি বলেন, তার আগে ১৯৯৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ফ্রন্ট জিহাদের যে ডাক দিয়েছিল, যেটা আল-কায়েদা সনদ হিসেবে পরিচিত, তাতে ফজলুর রহমান নামে এক বাংলাদেশির সই ছিল। সেই ফজলুর রহমান কে-তা এখনো জানা যায়নি।
শাফকাত মুনীর বলেন, এখন দেশে যে জঙ্গিবাদ চলছে, তা বুঝতে এর অতীতটা পর্যালোচনা করতে হবে। আফগান যুদ্ধে কতজন বাংলাদেশি অংশ নিয়েছিল, তাদের মধ্যে কতজন হুজি-বিতে যোগ দিয়েছিল, বাকিরা কোথায় আছে, এ সব তথ্য সংগ্রহ করতে হবে এবং খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
পাকিস্তান-আফগানিস্তানকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন হুজি ও জেএমবির মধ্যে ধর্মীয় মাজহাবগত পার্থক্য রয়েছে। হুজি সদস্যরা ছিলেন হানাফি মাজহাবের এবং দেওবন্দ ধারার কওমি মাদ্রাসা থেকে লেখাপড়া করা। আর জেএমবির সদস্যরা বেশির ভাগ এসেছেন মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে থাকা মাদ্রাসা থেকে এবং আহলে হাদিস ধারার মাদ্রাসা থেকে। জেএমবির নেতা-কর্মীরা সবাই এসেছেন আহলে হাদিস বা ‘লা মাজহাবি’ (মাজহাববিরোধী) ধারা থেকে। প্রতিষ্ঠাকালীন শীর্ষ নেতাদের একজন মো. ফারুক হোসেন ওরফে খালেদ সাইফুল্লাহ ছিলেন হানাফি মাজহাবের এবং সাবেক হুজি সদস্য। তিনি জেএমবিতে আসার আগে আহলে হাদিস মতাদর্শ গ্রহণ করেন।
আহলে হাদিস ধারাটি আগে ‘ওহাবি’ নামে বেশি পরিচিত ছিল। মধ্যপ্রাচ্যসহ বহির্বিশ্বে এরা সালাফি হিসেবে পরিচিত। ধারাটি বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হলেও মধ্যপ্রাচ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ। সৌদি আরবের মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে সালাফি ধারার ‘জিহাদি’ সংগঠন প্রতিষ্ঠার ধারণা পান বা আগ্রহী হন জেএমবির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত শায়খ আবদুর রহমান।
জেএমবির লক্ষ্য রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা। তারা ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী একযোগে ৫০০ বোমা ফাটিয়ে প্রচারপত্রে বলেছিল, তারা এ দেশে ‘আল্লাহর আইন’ বা শরিয়া আইন বাস্তবায়ন করতে চায়।
জেএমবিকে ‘হোমগ্রোন’ বা দেশজ সংগঠন বলা হলেও শুরু থেকেই এর প্রতিষ্ঠাতা শায়খ রহমানের লক্ষ্য ছিল আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা এবং তাদের সহযোগিতা নিয়ে এ দেশে সশস্ত্র লড়াইয়ের ক্ষেত্র তৈরি করা। এর মধ্যে পাকিস্তান, ভারত ও যুক্তরাজ্যকেন্দ্রিক সালাফি মতাদর্শের একাধিক সংগঠনের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ স্থাপনও করেছিলেন। নিজে অস্ত্র ও বিস্ফোরকের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন পাকিস্তানে জঙ্গিদের একটি আস্তানায়। গ্রেপ্তার থাকা অবস্থায় তিনি এর বিস্তারিত বিবরণ দেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে।
দেশে ফেরার পর শায়খ রহমান প্রথমে জামালপুরে তাঁর শ্বশুরের প্রতিষ্ঠিত মির্জা কাশেম সিনিয়র মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। সেখানে একটি সাবান কারখানাও প্রতিষ্ঠা করেন। পরের বছর ১৯৮৬ সালে সৌদি দূতাবাসে চাকরি নেন তিনি। সেখানে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত চাকরি করেন। এরপর কখনো সারের ব্যবসা, কখনো বিদেশ থেকে ছোলা ও মসুরের ডাল আমদানি, কখনো আরবি অনুবাদ প্রতিষ্ঠান—এমন নানা ব্যবসা করেন। ব্যবসার আড়ালে ‘জিহাদি’ সংগঠন করার প্রাক-প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এরই অংশ হিসেবে বিভিন্ন ছদ্মনামে ‘জিহাদি’ বই লেখা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে এসব বই জেএমবির সদস্যদের পাঠ্য ছিল।
জেএমবি প্রতিষ্ঠার আগে শায়খ আবদুর রহমান ১৯৯৫ সালে হরকাতুল জিহাদের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করেন। জবানবন্দিতে তাঁর ভাষ্য ছিল এমন—‘প্রাথমিকভাবে আমার হরকাতুল জিহাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু ধর্মীয় মতাদর্শগত, বিশেষত মাজহাবি পার্থক্যের কারণে আমি হরকাতুল জিহাদ সংগঠনের সঙ্গে কাজ করার প্রাথমিক চিন্তাধারা থেকে সরে এসে নিজস্ব দল গঠনের সিদ্ধান্ত নিই।’
সংগঠন তৈরির প্রস্তুতিপর্বে শায়খ রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ হয় ভারতের জঙ্গিনেতা আবদুল করিম টুন্ডার সঙ্গে। শায়খ রহমানের ভাষ্য অনুযায়ী, তখন ঢাকার যাত্রাবাড়ী আহলে হাদিস মতাদর্শের বড় মাদ্রাসার পাশে একটি ছাত্র মেসকে অফিস হিসেবে ব্যবহার করতেন পাকিস্তানের ভয়ংকর জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তাইয়েবার নেতা টুন্ডা। ১৯৯৭ সালের শেষের দিকে টুন্ডার ব্যবস্থাপনায় বিমানযোগে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে যান শায়খ রহমান। এরপর তাঁকে লাহোরে অবস্থিত মার্কাজ আদ-দাওয়া ওয়াল ইরশাদের (পাকিস্তানের একটি আহলে হাদিস সংগঠন এবং লস্কর-ই-তাইয়েবার মাতৃসংগঠন) প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে যান টুন্ডা। সেখান থেকে পরে মুজাফফরাবাদে গিয়ে লস্কর-ই-তাইয়েবার প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ২০ দিন অস্ত্র, বিস্ফোরক, রণকৌশল ও গোপনীয়তা রক্ষার কৌশল বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে আসেন তিনি।
জেএমবি প্রতিষ্ঠা করে নিজেই আমির হন শায়খ রহমান। ঢাকার খিলগাঁওয়ে একটি ভাড়া বাসায় বসে প্রথম শুরা কমিটি হয়। তাতে শায়খ আবদুর রহমান ছাড়া বাকি সদস্যরা ছিলেন খালেদ সাইফুল্লাহ, হাফেজ মাহমুদ, সালাউদ্দিন, নাসরুল্লাহ, শাহেদ বিন হাফিজ ও টাঙ্গাইলের রানা। অবশ্য পরে শাহেদ বিন হাফিজ ও রানা মতবিরোধের কারণে দল ছাড়েন। ২০০১ সালে শুরা কমিটিতে যুক্ত হন ফারুক হোসেন ওরফে খালেদ সাইফুল্লাহ, আসাদুজ্জামান হাজারী, আতাউর রহমান সানি (শায়খ রহমানের ভাই), আবদুল আউয়াল (জামাতা) ও সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই। তাঁদের মধ্যে ২০০২ সালে নাসরুল্লাহ রাঙামাটিতে বোমা বিস্ফোরণে মারা যান। ২০০৩ সালে আসাদুজ্জামান হাজারী অসুস্থতার কারণে সংগঠন ছেড়ে দেন। অন্যদের মধ্যে এখন সালাহউদ্দিন ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই। সালাহউদ্দিনকে ২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজনভ্যানে হামলা করে ছিনিয়ে নেন জঙ্গিরা।
শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মূলত ওই সব এলাকার আহলে হাদিস সম্প্রদায়ের একটি অংশের ওপর ভর করেই জেএমবির বিস্তার লাভ করেছে। এর মধ্যে বগুড়া, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, জয়পুরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রংপুর থেকে সবচেয়ে বেশি সদস্য সংগ্রহ করেছে বর্তমানে নিষিদ্ধ এই সংগঠন। প্রশিক্ষণকেন্দ্রও গড়ে তোলে এসব এলাকার চরাঞ্চলে।
তিন ধরনের প্রশিক্ষণ শেষে বাছাই করা সদস্যদের বোমা তৈরি ও অস্ত্র চালনার তালিম দেওয়া হতো। সদস্য সংগ্রহের পর প্রত্যেকের ছদ্মনাম বা সাংগঠনিক নাম দেওয়া হয়। এরপর ‘কাট আউট পদ্ধতিতে’ ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ করে কার্যক্রম চালানো হয়। বার্তা আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে নানা ‘কোড’ শব্দ ব্যবহার করে জেএমবি। আর এসব সাংগঠনিক গোপনীয়তা রক্ষার কৌশল লস্কর-ই-তাইয়েবা থেকেই শিখেছেন বলে শায়খ আবদুর রহমান জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন। কারও দায়িত্ব বা কর্ম এলাকা যতবার পাল্টায়, ততবার নতুন নতুন ছদ্মনাম ধারণ করতেন তাঁরা। শায়খ রহমানের নিজের ছদ্মনাম ছিল এহসান। শুরুর দিকে তাঁরা কয়েকজন বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি পাহাড়ে রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠীর ক্যাম্পে গিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র চালনা শিখে এসেছিলেন। বিনিময়ে তাঁদের বোমা তৈরির (আইইডি) প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।
অবশ্য জেএমবির প্রথম পর্বে আগ্নেয়াস্ত্রের খুব একটা ব্যবহার ছিল না। তারা মূলত বোমার ব্যবহার করেছে, যার বেশির ভাগ উপাদান দেশ থেকে নেওয়া। বিস্ফোরক জেলসহ কিছু কিছু উপাদান ভারত থেকে সংগ্রহ করা হতো। শায়খ রহমান বলেছেন, তাঁরা কিছু ওয়ান শুটারগান (হাতে তৈরি দেশীয় অস্ত্র) ভারত থেকে এনেছিলেন। এর বাইরে বাংলা ভাই একটি এসএমজি ব্যবহার করতেন, সেটা বাগমারায় চরমপন্থীদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া।
জেএমবির প্রথম পর্বে, অর্থাৎ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ফাঁসির আগ পর্যন্ত কত সদস্য ছিলেন, তার কোনো প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায় না। জোট সরকারের আমলে বিভিন্ন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে কখনো ৫ হাজার, কখনো ২৫ হাজার সদস্য থাকার কথা বলা হয়েছিল। তবে এ বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করেন, এমন ব্যক্তিদের তখনকার ধারণা ছিল, এহসার (সার্বক্ষণিক কর্মী), গায়রে এহসার (সাধারণ সদস্য বা সমর্থক) ও তাঁদের স্ত্রীদের সদস্য হিসেবে ধরলে মোট সদস্য ৫ হাজার হতে পারে। এর মধ্যে ২০০৫ সালে দেশব্যাপী বোমা হামলার পর সাত শতাধিক গ্রেপ্তার হন।
২০০২ সালে ভারতের মালদহে জেএমবির ৬৫তম কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির সহায়তায় ভারত থেকে অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য সংগ্রহ করা হতো বলে পরে জঙ্গিনেতারা জবানবন্দিতে বলেছেন। ২০১৪ সালে ভারতের বর্ধমান বিস্ফোরণের ঘটনার পর সে দেশে জেএমবির উপস্থিতির কথা আলোচনায় আসে।
তবে পরবর্তী সময়ে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাস্তবে জেএমবির প্রথম নাশকতার শুরু ২০০১ সালে। ওই বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরার রক্সি সিনেমা হল ও সার্কাস মাঠে বোমা হামলা চালায় তারা। এতে ৩ জন নিহত ও প্রায় ১০০ জন আহত হন। এরপর ২০০২ সালের ১ মে নাটোরের গুরুদাসপুরে কিরণ সিনেমা হলে ও ৭ ডিসেম্বর ময়মনসিংহে চারটি সিনেমা হলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্টের আগ পর্যন্ত ১৮টি ঘটনা ঘটায় তারা। তারপরও তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের টনক নড়েনি। বরং দেশে জঙ্গি নেই, এসব মিডিয়ার (গণমাধ্যম) সৃষ্টি বলে দায় এড়াতে চেয়েছিল তারা। বিস্ময়করভাবে ময়মনসিংহের সিনেমা হলের বোমা হামলা মামলায় আসামি করা হয় শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন, সাবের হোসেন চৌধুরীর মতো ব্যক্তিদের।
২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে এসে জেএমবি উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ব্র্যাক ও গ্রামীণ ব্যাংকে ডাকাতি শুরু করে। এ নিয়ে দেশে-বিদেশের চাপের মুখে তৎকালীন সরকার ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি জেএমবি ও জেএমজেবিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
জেএমবির নেতাদের ধারণা ছিল, ১৭ আগস্ট হামলায় ব্যবহৃত বোমায় যেহেতু স্প্লিন্টার দেওয়া হয়নি এবং এতে হতাহত হবে না, তাই সরকার খুব একটা কিছু করবে না। এ ছাড়া এক বছর আগে রাজশাহীর তিন উপজেলায় তাদের তৎপরতায় স্থানীয় পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ-মন্ত্রীরা যেভাবে সহযোগিতা দিয়েছিলেন, তাতেও জেএমবির নেতাদের মধ্যে এমন প্রত্যাশা জন্মেছিল।
কিন্তু ১৭ আগস্টের হামলার পর নানামুখী চাপে র্যাব-পুলিশকে ব্যাপকভাবে অভিযানে নামতে হয়। কিন্তু নভেম্বর-ডিসেম্বরে জেএমবি ঝালকাঠি, চট্টগ্রাম, গাজীপুর ও নেত্রকোনায় পাঁচটি আত্মঘাতী হামলা চালায়। ওগুলোই ছিল দেশে জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রথম আত্মঘাতী হামলা। জেএমবি সাড়ে ৪ বছরে ২৬টি হামলায় ৭৩ জনকে হত্যা করে। এসব ঘটনায় আহত হন প্রায় ৮০০ মানুষ।
শায়খ আবদুর রহমান জবানবন্দিতে বলেছেন, তাঁদের সঙ্গে পাকিস্তানের লস্কর-ই-তাইয়েবার বাইরে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আল মুহাজেরুন নামের একটি জিহাদি সংগঠনের যোগাযোগ ছিল। এর প্রধান সিরীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক শায়খ ওমর বাক্রি। সংগঠনটি বাংলাদেশে তাদের সদস্যদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার জন্য জেএমবিকে অনুরোধ করেছিল। তারা এসে চরাঞ্চলে জেএমবির প্রশিক্ষণ সরেজমিনে দেখেও যায়। পরে ১৭ আগস্টের হামলার পর জেএমবি চাপে পড়লে টেলিফোনে আল মুহাজেরুনের নেতারা জেএমবিকে বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাসে হামলা, র্যাবের ওপর আক্রমণ এবং বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অপহরণ বা তাঁদের ওপর হামলা চালানোর পরামর্শ দিয়েছিল বলে জানান শায়খ রহমান।
২০০৬ সালের ২ মার্চ সিলেটে সপরিবার গ্রেপ্তার হন শায়খ রহমান। এর আগে-পরে বাংলা ভাইসহ জেএমবির তখনকার শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় সব নেতা ধরা পড়েন। ২০০৬ সালে জোট সরকারের শেষ দিকে জেএমবির প্রধান শায়খ আবদুর রহমান, দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইসহ ছয় জঙ্গির ফাঁসির আদেশ হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পর ২০০৭ সালের ৩ মার্চ তাঁদের ফাঁসি কার্যকর হয়। এর মধ্য দিয়ে জেএমবির প্রথম পর্বের সমাপ্তি ঘটে। এরপর হবিগঞ্জের মাওলানা সাইদুর রহমানের নেতৃত্বে নতুন কমিটি করে সংগঠনটি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ২০১০ সালে তিনিসহ নতুন নেতৃত্বের অনেকে ধরা পড়ায় সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
এর পরপরই সক্রিয় হয় আল-কায়েদার অনুসারী আরেক সংগঠন আনসার আল ইসলাম। ২০১৩ সালে ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যার মধ্য দিয়ে এরা আলোচনায় আসে। আর ভঙ্গুর জেএমবির গর্ভ থেকে জন্ম নেয় আরেকটি জঙ্গিগোষ্ঠী। এরাই এখন নিজেদের আইএস দাবি করে দেশে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে।
কলম্বোভিত্তিক রিজিওনাল সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদের মতে, ‘সারা বিশ্বে এখন যে সন্ত্রাসবাদ আমরা দেখছি, সেটার মূলে রয়েছে সালাফিবাদ। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়।’ তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিগত শতকের সত্তরের দশক থেকে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু ধনী সালাফিবাদ প্রসারে বিনিয়োগ শুরু করে। এরপর গত সাড়ে তিন দশকে সালাফিবাদের পাশাপাশি উগ্র মতাদর্শ ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে। এ থেকে ইউরোপ-আমেরিকাও বাদ যায়নি।
অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, ‘আমরা শান্তির ধর্ম ইসলামের কথা বলি। কিন্তু সেটা মুখে মুখে। উগ্রবাদের বিপরীতে সহিষ্ণু ইসলামের প্রচার-প্রসারের জন্য কোনো উদ্যোগ, বিনিয়োগ নেই। এ বিষয়ে রাষ্ট্রও মনোযোগ দেয়নি।’
সাত বছর বিরতির পর আবার হামলা ও হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে দেশে ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে দুটি জঙ্গিগোষ্ঠী। আগের দুটি সংগঠনের ভেতর থেকে জন্ম নেওয়া এ দুই সংগঠন গত সাড়ে তিন বছরে ৬২টি হামলায় জড়িত বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছে ৯৪ জন। এর মধ্যে সর্বশেষ গুলশানে হামলার মধ্য দিয়ে চরম নৃশংসতা নিয়ে হাজির হয়েছে আইএস মতাদর্শ অনুসরণকারী গোষ্ঠীটি। এ হামলার পর বাংলাদেশের নাম সন্ত্রাসবাদী হামলার বৈশ্বিক মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
২০১৩ সাল থেকে মাঠে নামা দুই জঙ্গি সংগঠনের একটি হলো আল-কায়েদার অনুসারী আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (বর্তমান নাম আনসার আল ইসলাম) এবং অপরটি সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী ‘নব্য জেএমবি’, যারা নিজেদের আইএস দাবি করে। লক্ষ্যবস্তু বা টার্গেট এখন পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন হলেও দুটি সংগঠনই সালাফি বা আহলে হাদিস মতাদর্শী। দুই গোষ্ঠীরই সদস্যদের বড় অংশ তরুণ এবং ইংরেজিমাধ্যম স্কুল ও সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া করা সচ্ছল পরিবারের সদস্য।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ইংরেজিমাধ্যমে পড়ুয়া ও সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে এ দেশে ধর্মভিত্তিক উগ্র গোষ্ঠীর তৎপরতা শুরু হয়েছে অন্তত দেড় দশক আগে। আর এর শুরুটা করেছে ধর্মভিত্তিক আরেক সংগঠন বর্তমানে নিষিদ্ধ হিযবুত তাহ্রীর। এর পরপর যুক্ত হয় জামাআতুল মুসলেমিন নামে আরেক সালাফিবাদী সংগঠন, যার গর্ভ থেকে জন্ম নেয় আনসারুল্লাহ বাংলা টিম।
সূচনায় হিযবুত তাহ্রীর: খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে বিভিন্ন দেশে সক্রিয় আন্তর্জাতিক সংগঠন হিযবুত তাহ্রীর বাংলাদেশে আত্মপ্রকাশ করে ২০০১ সালে। উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়া কিছু ব্যক্তির মাধ্যমে যুক্তরাজ্য থেকে হিযবুত তাহ্রীর মতাদর্শ এ দেশে আসে।
সম্পূর্ণ নগরকেন্দ্রিক এই সংগঠন শুরু থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া সচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীদের লক্ষ্যবস্তু করে কার্যক্রম শুরু করে। ২০০৩ সাল থেকে হিযবুতের কার্যক্রম দৃশ্যমান হতে শুরু করে। শুরুর দিকে মূলত ঢাকার বিভিন্ন শীতাতপনিয়ন্ত্রিত মিলনায়তনে ঘরোয়া সভা-সেমিনার করত তারা। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা ভঙ্গ করে ঢাকায় মিছিল-সমাবেশ করে সংগঠনটি প্রথম দেশের গণমাধ্যমের দৃষ্টি কাড়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) কয়েকজন শিক্ষকের নেতৃত্বে দেশে হিযবুত তাহ্রীরের যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে সংগঠনটি ঢাকার বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিস্তার লাভ করে। এর মধ্যে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় উল্লেখযোগ্য।
হিযবুত তাহ্রীর মনে করে, গণতন্ত্র একটি ‘কুফরি’ মতবাদ। তাই গণতন্ত্র ‘অবশ্য পরিত্যাজ্য’। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত সংগঠনটির পোস্টার, পুস্তিকা, প্রচারপত্রেও একই রকম কথা বলা হয়।
সংগঠনটি নিষিদ্ধ হওয়ার আগে বিভিন্ন সময়ে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে হিযবুতের শীর্ষস্থানীয় একাধিক নেতার কথা হয়। তাঁরা দাবি করেন, তাঁরা অন্য জঙ্গি সংগঠনের মতো নাশকতা বা সশস্ত্র পন্থায় লক্ষ্য অর্জনে বিশ্বাসী নন। তাঁরা মনে করেন, মুসলিমপ্রধান দেশে সরকারি বাহিনীকে উদ্বুদ্ধ করে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এ জন্য সরকারি বাহিনী ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তিদের সন্তানদের প্রতি সংগঠনটির বাড়তি আগ্রহ রয়েছে। নিষিদ্ধ হওয়ার আগে-পরে সরকারি বাহিনীর উদ্দেশে পোস্টার, প্রচারপত্রও প্রকাশ করে হিযবুত তাহ্রীর।
২০০৮ সালে সংগঠনটির গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেছিলেন, তখন পর্যন্ত তাঁদের সদস্যসংখ্যা ১০ হাজারের অধিক। যাঁদের অধিকাংশই রাজধানীকেন্দ্রিক। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট ও কুমিল্লায় সংগঠনটির কার্যক্রম আছে, সদস্যসংখ্যা খুব বেশি নয়।
সরকার ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর ‘জননিরাপত্তার স্বার্থে’ হিযবুত তাহ্রীরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এরপর সংগঠনটির বেশ কিছু সদস্য গ্রেপ্তার হন। তবে তাঁদের কার্যক্রম বন্ধ হয়নি। শুরুর দিকে সদস্যদের অনেকে লেখাপড়া শেষ করে বিভিন্ন ইংরেজিমাধ্যম স্কুল ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি নিয়েছেন। এঁরা সদস্য সংগ্রহে একটা বড় ভূমিকা রাখেন বলে অভিযোগ আছে।
ইউটিউবে থাকা আনসারুল্লাহর প্রধান তাত্ত্বিক নেতা মুফতি জসিমউদ্দিন রাহমানীর বিভিন্ন বক্তৃতা ও খুতবা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এ সংগঠনটির সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য সশস্ত্র লড়াই। তবে তার আগে সদস্য সংগ্রহ ও আর্থিক সামর্থ্য অর্জনকে জরুরি মনে করে এরা। রাহমানী সর্বশেষ রাজধানীর বসিলায় একটি মসজিদের খতিব ছিলেন।
২০১৩ সালে আনসারুল্লাহর প্রধান মুফতি জসিমউদ্দীনসহ আরও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তখন ঢাকার ডিবির একাধিক সূত্র জানিয়েছিল, জামাআতুল মুসলেমিনের ইজাজ হোসেন আনসারুল্লাহর অন্যতম প্রধান। তিনি পাকিস্তানে বসে ইন্টারনেট যোগাযোগের মাধ্যমে সংগঠনের কর্মীদের সক্রিয় রাখছেন।
২০১৩ সালে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে হত্যার পর এই সংগঠনের কথা প্রথম জানাজানি হয়। ওই ঘটনায় সরাসরি জড়িত সবাই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাঁদের মধ্যে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই মামলার বিচার শেষে রায়ে দুজনের ফাঁসি এবং মুফতি রাহমানীসহ বাকি পাঁচজনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়।
গণজাগরণ মঞ্চ সৃষ্টির পর থেকেই তাদের ভাষায় ‘নাস্তিক, ধর্মের অবমাননাকারী ব্লগার’দের হত্যার বিষয়ে আনসারুল্লাহর প্রধান জসিমউদ্দীন রাহমানী ফতোয়া দিচ্ছিলেন এবং খুতবায় বয়ান করে আসছিলেন। এসব তাঁরা তাঁদের ওয়েব পেজে প্রচারও করেছেন।
২০১৩ সালে রাজীব হত্যার পর দীর্ঘ বিরতি দিয়ে ২০১৫ সালে আবার হত্যাকাণ্ড শুরু করে আনসারুল্লাহ। তার আগে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে আল-কায়েদার নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরি এক ভিডিও বার্তার মধ্য দিয়ে আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা (একিউআইএস) প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। এর পরপরই বাংলাদেশের আনসারুল্লাহ একিউআইএসের অধিভুক্ত হয় বলে তখন ঢাকায় জঙ্গিবাদ দমনে যুক্ত গুরুত্বপূর্ণ একাধিক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেছিলেন। এরপর আনসারুল্লাহ নাম পাল্টিয়ে আনসার আল ইসলাম নাম ধারণ করে এবং নিজেদের একিউআইএসের বাংলাদেশ শাখা দাবি করে। আনসারুল্লাহ বা আনসার আল ইসলাম এ পর্যন্ত ১৩ জনকে হত্যার দায় স্বীকার করেছে। এঁদের বেশির ভাগই ব্লগার। এর বাইরে রয়েছেন প্রকাশক, শিক্ষক ও সমকামীদের অধিকারকর্মী।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, জসিমউদ্দীন রাহমানী গ্রেপ্তার হওয়ার পর আনসারুল্লাহর প্রধান হন পাকিস্তানপ্রবাসী ইজাজ হোসেন ওরফে সাজ্জাদ ওরফে কারগিল। এর আগ পর্যন্ত তিনি আনসারুল্লাহর অপারেশনাল প্রধান ছিলেন। ইজাজ গত বছর করাচিতে এক বন্দুকযুদ্ধে আল-কায়েদার আরও কয়েকজনের সঙ্গে নিহত হন। (সূত্র: পাকিস্তানের ডন পত্রিকা, ১০ জানুয়ারি ২০১৫)। এরপর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত ও পলাতক মেজর জিয়াউল হককে আনসারুল্লাহর সামরিক প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার বরাতে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে খবর বের হয়। দিন কয়েক আগে এই জিয়াকে ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে পুলিশ।
আনসারুল্লাহর কার্যক্রম পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মেজর জিয়া দায়িত্ব নেওয়ার পর সংগঠনটির হত্যাযজ্ঞের সংখ্যা বেশ বেড়ে যায়। মূলত চাপাতি ব্যবহার করলেও শেষ দিকে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারও করেছেন তাঁরা।
এখন পর্যন্ত নাশকতা বা বিস্ফোরক ব্যবহার না করলেও গত ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে ঢাকায় সংগঠনটির তিনটি আস্তানা থেকে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধারের দাবি করেছে পুলিশ। তাদের আস্তানায় তখন গাড়িবোমা তৈরির আলামত মিলেছিল বলেও পরে খবর বের হয়।
অবশ্য এই ‘নব্য জেএমবি’ নিজেদের আইএস দাবি করে। এই গোষ্ঠীর সঙ্গে পুরোনো জেএমবির অনেক তফাত। নব্য জেএমবির সদস্যদের একটা বড় অংশ আধুনিক, বিত্তবান পরিবারের সন্তান, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আইএস যাদের শত্রু মনে করে, এরাও তাদের শত্রু মনে করে। এরাই এ দেশে প্রথম শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলা করেছে। এ ছাড়া একের পর এক পুরোহিত, সেবায়েত, বৌদ্ধভিক্ষু, খ্রিষ্টানধর্মের মানুষ ও বিদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে। এসব হত্যার পর নিহতদের ‘ক্রুসেডার’ আখ্যা দিয়ে আইএসের নামে দায় স্বীকার করা হয়।
বিভিন্ন সময়ে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আইএস অনুসারী এই জঙ্গিগোষ্ঠী সংগঠিত হচ্ছিল বছর তিনেক ধরে; যার প্রথম প্রকাশ সম্ভবত ২০১৩ সালের ৮ আগস্ট খুলনার খালিশপুরে উম্মুল মোমেনিন দাবিদার কথিত ধর্মীয় নেতা তৈয়বুর রহমান ও তাঁর কিশোর ছেলেকে জবাই করে হত্যার ঘটনা। এর চার মাস পর ২১ ডিসেম্বর ঢাকার গোপীবাগে ইমাম মাহদীর প্রধান সেনাপতি দাবিদার লুৎফর রহমানসহ ছয়জনকে একই কায়দায় হত্যা করা হয়।
এরপর গত বছরের ২১ এপ্রিল আশুলিয়ায় ব্যাংক ডাকাতির আগ পর্যন্ত এই গোষ্ঠীর হত্যাযজ্ঞের খবর পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয়, এই দেড় বছর ছিল তাদের প্রস্তুতির পর্ব। এই নব্য জেএমবিতেও যে শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের সন্তান, ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়া ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ভিড়ছে, তা অনেক আগেই আঁচ করা যাচ্ছিল। ২০১৪ সালে একটি বহুজাতিক কোম্পানির আইটি শাখার প্রধান আমিনুল বেগ এবং একাধিক সামরিক-বেসামরিক পদস্থ কর্মকর্তার ছেলে ও লন্ডনপ্রবাসী গ্রেপ্তার হওয়ার পর বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
গুলশানে হামলায় নিহত এবং পরে কল্যাণপুরে পুলিশের অভিযানে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেও জানা গেছে, এঁদের আচরণে পরিবর্তন দেখা গেছে বছর তিনেক আগে থেকে।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় ইতালির নাগরিক সিজার তাবেলা এবং ৩ অক্টোবর রংপুরে জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিকে হত্যার পর আইএস দায় স্বীকার করলে সরকার তা জোরের সঙ্গে নাকচ করে দেয়। তবে আইএস আছে বা নেই—এই বিতর্কে হত্যাকাণ্ড থেমে থাকেনি। এই গোষ্ঠী সারা দেশে গত ১০ মাসে ৪২টি হামলা ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। এর মধ্যে ২৮টি ঘটনায় আইএস দায় স্বীকার করেছে। সর্বশেষ দায় স্বীকার করে গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার। কেবল তা-ই নয়, ১২ ঘণ্টার জিম্মি সংকট চলাকালে ভেতরের হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কয়েক দফা আপডেট ও নিহত ব্যক্তিদের ছবি প্রকাশ করেছে এই গোষ্ঠী।
সিঙ্গাপুরভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স অ্যান্ড টেররিজমের (আইসিপিভিটি) প্রধান রোহান গুনারত্ন রয়টার্সকে বলেছেন, তিনি গবেষণায় পেয়েছেন যে, বাংলাদেশের জঙ্গিরা আইএসের কাছ থেকে আর্থিকসহ সাংগঠনিক নির্দেশনা ও অন্যান্য সহায়তা পেয়েছে। ৩ আগস্ট রয়টার্সের এ-বিষয়ক এক প্রতিবেদনে রোহান গুনারত্নের এই বক্তব্য উল্লেখ করা হয়। এর আগে গত ২১ মে থেকে রোহান গুনারত্নের নেতৃত্বে আইসিপিভিটি ঢাকায় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ইউনিটের সদস্যদের পাঁচ দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ দিয়েছিল।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, আধুনিক প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন এসব জঙ্গি মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। গত কয়েক বছরে বেশ কিছু জঙ্গি গ্রেপ্তার হলেও পরিস্থিতি যে এত ভয়ংকর পর্যায়ে যাচ্ছে, তা অনুধাবনের ক্ষেত্রে সরকারের বাহিনীগুলোর ঘাটতি ছিল। তবে গুলশান হামলার পর সরকার জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে। গত ২৬ জুলাই ভোরে ঢাকার কল্যাণপুরে পুলিশের অভিযান এবং নয় জঙ্গি নিহত হওয়ার ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, গুলশান হামলার মতো আরেকটি ভয়ংকর হামলা থেকে দেশ রক্ষা পেয়েছে।
তবে এখনো মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়ে গেছে। একই সঙ্গে দেশের সব মহলে জঙ্গিবাদবিরোধী একটা মতৈক্য তৈরি হয়েছে।
২০১৫ সালের ২৪ মে আমিনুল বেগ ও সাকিব বিন কামাল নামে দুজনকে গ্রেপ্তারের পর ডিবি কর্মকর্তারা বলেছিলেন, দেশের কিছু যুবক আইএসের পক্ষে লড়াই করতে সিরিয়া বা ইরাকে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। আমিনুল বেগ এমন একটি দলের নেতা। কয়েকজন আইএসে যোগ দিতে সিরিয়ায় চলে গেছেন। আরও ২০-২২ জন যাওয়ার চেষ্টায় আছেন। এমন কিছু ব্যক্তিকে পরবর্তী সময়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল বলে তখন পুলিশের পক্ষ থেকে বলাও হয়েছিল। আমিনুল বেগ ও সাকিব এখন কারাগারে আছেন।
বাংলাদেশ থেকে কেউ সিরিয়ায় গিয়ে আইএসে যোগ দিয়েছে কি না, এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেনি। তবে বিচ্ছিন্নভাবে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে এ পর্যন্ত ১৫ জন বাংলাদেশির নাম এসেছে, যাঁরা সিরিয়া গেছেন বলে মনে করা হয়। এঁদের মধ্যে দুজন সেখানে মারাও গেছেন। একজন বিডিআর বিদ্রোহে নিহত এক সেনা কর্মকর্তার ছেলে আশিকুর রহমান এবং অপরজন সাইফুল হক, যনি ২০১৪ সালের আগস্টে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে সিরিয়ায় যান। গত বছরের ১০ ডিসেম্বর আইএসের কথিত রাজধানী সিরিয়ার রাকায় বিমান হামলায় নিহত হন সাইফুল। ২৯ ডিসেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এ খবর প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, সাইফুল আইএসের শীর্ষস্থানীয় ১০ জনের একজন ছিলেন। তিনি আইএসের হয়ে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের পরিকল্পনাকারী, হ্যাকিং কর্মকাণ্ড, নজরদারি প্রতিরোধ প্রযুক্তি ও অস্ত্র উন্নয়নের কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
দ্য ফিসক্যাল টাইমস নামে মার্কিন সাময়িকীর গত বৃহস্পতিবারের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, ইরাক ও সিরিয়ায় আইএস দ্রুত ভূমি হারাচ্ছে। তবে মার্কিন কর্মকর্তারা মনে করছেন, এটা নতুন এক উদ্বেগের জন্ম দিতে পারে। এটা শুধু পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য উদ্বেগের কারণ হবে না। মার্কিন প্যাসিফিক কমান্ডের কমান্ডার অ্যাডমিরাল হ্যারি হ্যারিস সম্প্রতি বলেছেন, ‘আমার বিশ্বাস, ভারত-এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করছে আইএস।’ সাময়িকীটি বলেছে, মার্কিন সেনা কর্মকর্তার এই বক্তব্য এমন এক সময় এলো, যখন বাংলাদেশ ও ফিলিপাইনের মতো এশিয়ার দেশগুলোয় একের পর এক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটছে।
জঙ্গিবাদ বিষয়ক গবেষক, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজের মতে, এখন যে পরিস্থিতি, তাতে আল-কায়েদা না আনসারুল্লাহ, আইএস না জেএমবি বলব; এ বিতর্কের সময় পেরিয়ে গেছে।
আলী রীয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, বৈশ্বিকভাবে জঙ্গিবাদ উত্থানের একটা পরিবেশ তৈরি রয়েছে। এখন দেশের অভ্যন্তরেও অনুকূল পরিবেশ থাকলে তা দ্রুত বন্ধ করতে হবে। কেবল সামরিকভাবে পদক্ষেপ নিয়ে বা জঙ্গিদের মেরে দমন করা যাবে না। একটা রাজনৈতিক কৌশল থাকতে হবে, যাতে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে যুক্ত করা যায়।